হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন কা‌হিনী



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

আমরা যারা মুসলিম ঘরের সন্তান সবাই বলি আলহামদুলিল্লাহ। প্রিয় পাঠক আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনি এই পোস্ট টি পড়তে এসেছেন। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি যে তার নির্দেশে আমরা এখনো জীবিত আছি আবারও বলি আলহামদুলিল্লাহ।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন কা‌হিনী


আমি আজকে আমাদের প্রিয় নবী আমাদের মহানায়ক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন কাহিনী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আপনি ধৈর্যের সহিত পুরো পোস্টটি পড়বেন।

    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম:


    হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীতে কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন হাদিস থেকে ও ইসলামিক বই থেকে আমরা জানতে পারি, উনার জন্ম ৫৭০ খৃস্টাব্দে। তবে আরও কিছু হাদিস এ বিভিন্ন সময় উল্লেখ করা আছে। তবে তার প্রকৃত জন্মতারিখ বের করা খুবীই কষ্টসাধ্য।

    তাছাড়া মুহাম্মদ (সা) নিজে কোনোর রকম মন্তব্য করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই জন্যই এ নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ এখনো লেগেই আছে। শুধু জন্মসাল না, জন্মমাস নিয়েও ব্যপক মতবিরোধ রয়েছে । যেইতাই হোক, বেশী বর্ণনা মতে, উনার জন্ম ৫৭১ সালের ২০ বা ২২ শে এপ্রিল। নবীর জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে দখলের ৪০ বছর পূরণ ছিল এ নিয়ে কারো মধ্যে কোন দু'রকম মতামত নেই।

    তাঁর মাতা আমেনা এবং পিতা আব্দুল্লাহ । জন্মের পূর্বেই মুহাম্মাদ (স) পিতা হারিয়ে এতীম হয়ে যান । ৬ বছর বয়সে তার মা আমেনা এবং ৮ বছর বয়সে দাদা আবদুল মোত্তালেব মারা যাবার পর  মুহাম্মাদ (স) এর সব রকম দায়িত্ব ও ভরণপোষণ গ্রহন করেছিলেন তার নিজ চাচা আবু তালেব।


    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশ পরিচয়:


    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম


    কুরাইশ বংশ ছিল তৎকালীন আরব সমাজের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী বংশ।
    রাসুল(সঃ)-এর মাতার নাম আমিনা,পিতার নাম আবদুল্লাহ্, দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম, চাচার নাম আবু তালিব এবং নানার নাম ওহাব বিন আবদে মানাফ।

    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শৈশব ও কৈশোর কাল:



    সেইকালে আরবের রীতিনিতী ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গঠন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতিনিতী অনুযায়ী মোহাম্মদকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের [অপর নাম হালিমা সাদিয়া] হাতে দিয়ে দেয়া হয়। 

    এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় একের পর এক হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসত এবং তারা এই শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটা ঘটনা উল্লেখযোগ্য আছে যে – শিশু মোহাম্মদ সবসময় কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন তিনি। দুই বছর লালনপালন করার পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। 

    কিন্তু এর পরপরই পুরো মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে আবারও হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও মনে মনে চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে, এতে করে তার আশা ও পূর্ণ হল। ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরেই একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে , একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা আবার জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে দেয়া হয়। 

    এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মাদকে মা আমিনার কাছে আবার ফিরিয়ে দেন। ৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন তিনি, সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করবেন তিনি। আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় যান। 

    তিনি মদীনায় একমাস থাকেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছে যান। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন, তখন তার দাদা আবদুল মোত্তালেব মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র  আবু তালিবকে মোহাম্মদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

    মোহাম্মদের চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতে হতো তাকে। মুহাম্মাদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়াতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেন। অনেক মমতার কারণে আবু তালিব আর তাকে নিষেধ করতে পারেন নি। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছানোর পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। 

    সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস সামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করতেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। 

    ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমাদের নবীর বয়স মাত্র ১৫ বছর ছিল। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং নিজে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। ঐ  সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করব বলে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেন।


    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিবাহ:

     

    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার জীবনের বড় একটা অংশকাটিয়েছেন একাকী নিঃসঙ্গ। তার যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়, ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি থেকেছেন, তার থেকেও ১৫ বছর বেশি বয়স হবে প্রায় একজন নারীর সাথে, যিনি বিধবা ছিলেন পূর্বেই দুইবার বিয়ে হয়েছিল। 

    অথচ নবীজি (সা.) ছিলেন তখন একজন ফুটফুটে অপরূপ সুন্দর যুবক,ছিল সুঠাম বডি, যাকে আল্লাহ সভ্যতা ও সংস্কৃতির যাবতীয় ব্যাধি থেকে তাকে অনেক দূরে রেখেছিল। দ্বিতীয় বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ৫০ এর উপরে। সেই সময় বিয়ে করেছিলেন, সাওদা বিনতে যামআ (রা.) কে, তখন তার বয়স ছিল নবীজির বয়সের কাছাকাছি। 

    আয়েশা (রা.) ছাড়া কোনো অবিবাহিত ও কুমারী মেয়েকে তিনি বিয়ে করেননি। ফলে নবীজি (সা.) এর একাধিক বার বিয়ে নিয়ে নবুয়তের পূর্বে ও পরে কেউ কোন সমালোচনা করেন নিএমনকি আরবরাও নয়, তাঁর কোন নিকৃষ্ট শত্রুও নয়। 

    তার চরিত্র গুণের কথা আধুনিক মনোবিশ্লেষকেরাও অস্বীকার করেননি। নবীজির (সা.) এর জীবন যাপনে ভোগ-বিলাসের কোন জায়গা ছিল না। ত্যাগ, নিরাসক্ত ও যুহদ অল্পে তুষ্টির জীবন ছিল তার, যে জীবন আগের প্রাচীনকালের বড় বড় নামকরা সন্ন্যাসীদের মধ্যেও পাওয়া যায়নি।

    আবার সব জীবন সঙ্গীরা স্বার্থ ছাড়াই নবীজি (সা.) এর সাথে থেকে পরকালের জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন নবীজির নবুওয়াত হাসিলের সহচর। নবীজির (সা.) সঙ্গে তাঁরা কেউ কেউ একেক সময় অভিযানে অংশ নিতেন। তার পারিবারিক জীবনের বিধিবিধান উম্মতের সামনে তুলে ধরতেন।

    এছাড়াও প্রতিটি বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের কল্যাণ কিংবা মুসলমানদের সামাজিক আপদ বিপদ থেকে রক্ষা করা ছিল নবিজির মূল উদ্দেশ্য। আরবদের গোত্রের সমাজে বিয়ের আত্মীয়তার গুরুত্ব ছিল অনেক বড়, রক্তপাত হাওয়া থেকে বাঁচার প্রধান ভূমিকা রাখত।



    নবীজি (সা.) বহুবিবাহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো:



    ১। একমাত্র ইসলামের পারিবারিক বিধান হলো শিক্ষা দেওয়া। কেননা, নবীজির (সা.) ঘরের কাজ, পরিবারের সবার সাথে ভালো আচারণ করা, আবার রাত্রিকালীন ইবাদত করা ইত্যাদি। স্ত্রীদের মাধ্যম ছাড়া জানার উপায় ছিল না তার। নারীদের ব্যক্তিগত বিধান হলো, যা পুরুষের মাধ্যমে জানা লজ্জার, তার জন্যও তাঁরা রাতে আসতেন নবীজির (সা.) স্ত্রীদের কাছে।

    ২। দুই. ইসলামে ধনী বা দাস সবাই সমান এবং বিয়েতে কুমারী ও বিধবা মর্যাদা সমান কোনো পার্থক্য নেই, এই সাম্য শিক্ষা দেওয়া। নবীজির (সা.) স্ত্রী সাফিয়া (রা.) ছিলেন ইহুদির মেয়ে এবং জুয়াইরিয়া (রা.) ছিলেন বেদুইন দলপতির কন্যা। উভয়ে এসেছিলেন দাসী হয়ে। উপরন্তু, সেকালে বিধবা নারীরা ছিলেন পশুর মতো বোঝা, বিয়ের অধিকার তাঁদের ছিল না। নবীজি (সা.) তাঁদের বিয়ে করেন এবং আয়েশা(রা.) ও হাফসা(রা.) এবং মায়মুনা (রা.) প্রমুখ অভিজাত নারীর সমমর্যাদা প্রদান করেন।

    ৩। ধর্মীয় বিধানের প্রয়োগ দেখানো। যেমন আরবে ‘পালক আত্মীয়তার প্রথা ছিল সেই সময়। পালকপুত্রকে আপন ছেলের মতো উত্তরাধিকারী এবং তাঁর স্ত্রীকে আপন পুত্রবধূ গণ্য করতেন তাঁরা। এই কুসংস্কার টাকে ভাঙতেই নবীজি (সা.) বিয়ে করেছেন জয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) কে। বিচ্ছেদের পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর পালকপুত্র জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)-এর স্ত্রী।

    শেষ কথা হলো নবীজির (সা.) বহুবিবাহ নিয়ে এ যুগে এসে অনেক সমালোচক মুখর হয়েছেন। ইংরেজ লেখক আর ভি সি বোদলে তাদের জবাবে বলেছেন, ‘মুহাম্মদের (সা.) দাম্পত্য জীবনকে পশ্চিমের মাপকাঠিতে যাচাই করার প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি, সেই সময় যেসব নিয়ম কানুন বা প্রথার জন্ম দিয়েছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও নয়।

    কেননা তাঁরা পশ্চিমা নন এমনকি খ্রিষ্টানও নন। বরং তিনি এমন এক দেশে ও যুগে জন্ম নিয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই নৈতিক ও চারিত্রিক বিধানের চালচলন ছিল। আমেরিকা ও ইউরোপের চারিত্রিক ও নৈতিক বিধানকে আরবদের চারিত্রিক ও নৈতিক বিধানের চেয়ে উত্তম ভাবার কোন কারণ নেই বা আছে বলে আমার মনে হয় না।

    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সন্তান গুলোর নাম:



    মা খাদিজার গর্ভে ৬ সন্তান জন্মগ্রহন করেন এবং এর মধ্যে ৪ জন মেয়ে এবং ২ জন ছেলে। মহানবীর সন্তানদের নামগুলা জথাক্রমেঃ কাসেম, জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, আব্দুল্লাহ এবং ফাতিমা। একমাত্র ফাতেমা ব্যতীত আর সবাই নবীর বেচে থাকা অবস্থাতেই মারা যায়।

    হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যু:



    বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পরে, হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা ওনেক বেশী হওয়ার কারণে পাগড়ীর ওপর থেকেও গরম অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতে থাকার পরেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর থেকে অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল সুধু,মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলো সব দান করে দেয়। 

    বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার খাওয়ার কারণে। অবশেষে ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ সন্ধাবেলা তিনি মৃত্যবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। আলী (রাঃ) তাকেঁ গোসল করায় এবং কাফন পরায়। আয়েশ (রাঃ) এর ঘরে যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন,জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়েছিল।
    Next Post Previous Post
    No Comment
    Add Comment
    comment url